এই দলিলে বর্তমান ও ভবিষ্য বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্যে কিছু সংস্কার প্রস্তাবনা পেশ করা হচ্ছে। এই প্রস্তাবনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে: ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সরকারের ডানা কাটছাঁট করে দেয়া; বাংলাদেশের ‘উইনার টেইকস ইট অল’ রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করা; নির্বাহী সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে খর্ব করা; সর্বোপরী, দেশের সকল খাতে জবাবদিহিতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টিতে কিছু কাঠামোগত সংস্কার করা। নিচে সংক্ষেপে এই প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হলো। জনহিতকর নীতিমালা (যেমন: সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, ইত্যাদি) সংক্রান্ত প্রস্তাবনা এখানে উল্লেখ করা হয়নি।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা
বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন রয়েছে। অতীতে, মোট ভোটের মাত্র ৩৫-৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েও একটি রাজনৈতিক দল বা জোট এককভাবে সংবিধান সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছিল। কিন্তু, প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা হলে সংবিধান সহজেই কোনো দল পরিবর্তন করতে পারবে না। এর মাধ্যমে সংসদে বিরোধী দল ও ছোটো ছোটো দলগুলোর কিছুটা ক্ষমতায়ন হবে।
যেমন, ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি সারাদেশের মোট ভোট পেয়েছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ। কিন্তু সংসদে আসন পেয়েছিল মাত্র ৩০টি বা ১০ শতাংশ। উচ্চকক্ষ থাকলে সেখানে তাদের মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে কমপক্ষে ১০০টি আসন থাকতো। আর তাদের সম্মতি ছাড়া আওয়ামী লীগ একাই হয়তো তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংবিধান সংশোধন করতে পারতো না। আর আমাদেরও হয়তো আজকের অবস্থা দেখতে হতো না।
আবার ছোটো কোনো দল, যাদের দেশব্যাপী পরিচিতি আছে কিন্তু কোনো আসন জিতে আসতে পারে না, তাদের জন্যও এই পদ্ধতি সহায়ক হবে। বাম ও অন্যান্য রক্ষণশীল দলগুলো এতে কিছুটা প্রতিনিধিত্ব পাবে। এসব দল সারাদেশের মোট ভোটের এক শতাংশও যদি পায়, তারা সংসদের উচ্চকক্ষে ৩টি আসন পাবে।
তবে উচ্চকক্ষের সদস্য পদগুলো হবে অনেকাংশেই আলঙ্কারিক। তাদের সম্মতি প্রয়োজন হবে অত্যন্ত বিরল কিছু প্রেক্ষাপটে। এই কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এসব পদে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ দেবে, যেমনটা ভারত ও যুক্তরাজ্যে করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী পদে মেয়াদের সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্র ও এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন এড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে সীমিত করতে হবে। এজন্য সবচেয়ে জরুরী হলো প্রধানমন্ত্রী পদে ‘টার্ম-লিমিট’ বেঁধে দেওয়া: অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং ওই রাজনৈতিক দলের প্রধানমন্ত্রীকে ভিন্ন ব্যক্তি হতে হবে। এতে করে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদধারীর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ঘটবে।
বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সরকারের এই তিন অঙ্গের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে যথাক্রমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপর। এই তিনটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে নেবেন না। আলাদা আলাদা ব্যক্তি এই তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন।
একই পরিবারের (পিতামাতা, ভাইবোন, সন্তান) সদস্যরা একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রধান হলে ওই দুই দল সংসদে ককাস বা জোটবদ্ধ হতে পারবেন না।
নিজ দলের বিপক্ষে সংসদ সদস্যদের ভোট দানের ক্ষমতা
কোনো বিল সংসদে উত্থাপনের পর একজন সংসদ সদস্য তার দলের হুইপের নির্ধারণ করা অবস্থানের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারবেন।
কোনো বিলের পক্ষে হুইপ তার দল থেকে আবশ্যিক সমর্থন প্রত্যাশা করতে পারেন — এবং সেক্ষেত্রে কোনো সংসদ সদস্য ওই সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানালে, ওই সংসদ সদস্যকে নিজ দল থেকে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে; তবে কোনো অবস্থাতেই ওই সংসদ সদস্যের পদ বাতিল হবে না।
শুধুমাত্র আস্থা ভোটে কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্য পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হয়ে যাবে।
নির্বাচনী প্রচারণা ও নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত সংস্কার
কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার মানদণ্ড হতে হবে অত্যন্ত উঁচু যেন তুচ্ছ কারণে নিজের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ থেকে জনগণ বঞ্চিত না হন।
আমাদের নির্বাচনী অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। একজন প্রার্থীর সর্বোচ্চ নির্বাচনী ব্যয় পাঁচ লক্ষ টাকার বিধান বাস্তবসম্মত নয়। সংসদীয় আসনের জনসংখ্যা ও মানুষের গড় আয়ের ভিত্তিতে এই সীমা বছর বছর হালনাগাদ করা যায়। প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত অর্থের উৎস হলফনামায় স্পষ্টভাবে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে: যেমন, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ ধার বা চাঁদা হিসেবে নেওয়া হলে, তার নাম ও পরিচয়, ইত্যাদি।
বর্তমানে প্রার্থীর হলফনামায় যেসব তথ্য (যেমন: ট্যাক্স, আয় ও সম্পত্তির তথ্য) প্রদান করেন, তার ফরম্যাট অত্যন্ত অস্পষ্ট, যা অপব্যবহার করার সুযোগ থাকে। এপিআই-এর মাধ্যমে ইন্টারনেটে প্রবেশযোগ্য উপায়ে সুনির্দিষ্ট ফরম্যাটে এই তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
প্রত্যেক প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারাভিযানের নামে বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে। এই নির্বাচন পরিচালন কমিটির সাময়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে। শুধুমাত্র এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেই প্রার্থী নির্বাচনী কাজে অর্থ লেনদেন করতে পারবেন, এমনকি তার নিজের ব্যক্তিগত অর্থে নির্বাচন পরিচালিত হলেও। এই অ্যাকাউন্ট থেকে কর্মী ও প্রচারণার খরচাখরচ পরিচালিত হবে। এই অ্যাকাউন্টে কেউ অর্থ অনুদান হিসেবে দিলে তা থেকে আয়করমুক্তির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এই অ্যাকাউন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে অচল হয়ে পড়বে। এই অ্যাকাউন্টে কোনো অর্থ থেকে থাকলে, ওই প্রার্থী পুনরায় কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হলে তিনি সেই অর্থ ব্যায় করতে পারবেন — পাশাপাশি, অন্য কোনো প্রার্থীকেও দান করা যাবে। কোনো বিদেশী সংস্থা বা ব্যক্তি নির্বাচনে অনুদান দিতে পারবেন না।
নির্বাচনী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান ও নির্বাচনে অর্থায়নের আইন লঙ্ঘনের অপরাধ বর্তমানে সংজ্ঞায়িত নয়। এই দুইটি বিষয়ে নির্বাচন পূর্ববর্তী, নির্বাচকালীন ও পরবর্তী অনুসন্ধানের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকবে। এক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রদান ও অর্থায়ন সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে সত্যতা মিললে নির্বাচন কমিশন আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করতে পারে এবং এক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে ওই সংসদ সদস্যের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
সংসদীয় সীমারেখা পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকতে হবে। সমতার স্বার্থে জনসংখ্যার অনুপাতে সীমারেখা পরিবর্তন করতে হবে। এই কারণে প্রত্যেক ওয়ার্ড পর্যায়ে জনসংখ্যা গণনা করতে হবে (সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। এই বিষয়ে পরিসংখ্যানবিদদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার নিজস্ব লোকবল থাকবে। অন্তত ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা থাকবেন। এই কর্মকর্তারা যেই জেলা থেকে সরকারি চাকরিতে এসেছেন এবং যেই জেলায় কর্মরত থাকবেন, সেসব জেলায় তারা নির্বাচন পরিচালনায় সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।
‘নির্বাচনের সময় সরকার কমিশনের অধীনে চলবে’ — এই অস্পষ্ট বিধান যথেষ্ট নয়। সুস্পষ্ট বিধিমালায় বর্ণনা থাকতে হবে কমিশনের কী ক্ষমতা থাকবে, আর কী থাকবে না। প্রত্যেক জেলায় নির্বাচন কমিশন ঠিক কতজন প্রতিরক্ষা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করতে পারবে, তার সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে। যেমন, ভোলার সংসদীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে কোন উপজেলায় বা ইউনিয়নে কতজন নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন ও কতজন আপতকালীন সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারণ থাকতে হবে। এই সংখ্যা নির্ধারিত হতে পারে ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ের জনসংখ্যা অনুপাতে।
বাংলাদেশের সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক কর্মকর্তা ও সদস্য বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন।
এক জেলার নিরাপত্তা বাহিনীকে ওই জেলায় নির্বাচনী কাজে মোতায়েন করা যাবে না। যেসব পুলিশ সদস্য নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন না, তারা কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে জড়িত হতে পারবেন না — তারা শুধু সাধারণ ও নৈমিত্তিক আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর বাহুতে দৃশ্যমান ব্যাজ রাখা যেতে পারে।
নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা কী ধরণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, তার বিধান থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের প্রত্যেক সদস্যের বিপরীতে ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতি মনোনীত একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত হতে হবে। এই বিষয়ে ”রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ“ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
অন্যান্য সাংবিধানিক পদের মতো নির্বাচন কমিশনারদের অভিশংসনের ক্ষমতাও সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে উভয় কক্ষের হাতে ন্যস্ত থাকবে। তবে অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে।
সংসদের তদারকি ক্ষমতা বৃদ্ধি
সংসদ সদস্যেদের — বিশেষ করে সংসদীয় কমিটিকে ব্যাপক তদারকি (নির্বাহী নয়) ক্ষমতা দিতে হবে। সরকারি, বেসরকারি কিংবা অলাভজনক যেকোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে বাধ্যতামূলকভাবে তলব করা ও প্রশ্ন করার ক্ষমতা দিতে হবে। সংসদীয় কমিটি চাইলে সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে যেকোনো মন্ত্রীকেও তলব করতে পারে।
প্রত্যেক কমিটির প্রশ্নোত্তর পর্ব (জাতীয় নিরাপত্তা ও আদালতে বিচারাধীন বিষয় ব্যতীত) সংসদ টিভিতে প্রচার করা যেতে পারে। সংসদীয় কমিটির শুনানি সরকারি সভার মতো আয়োজন করা যাবে না। সংসদীয় কমিটির সদস্যদের বিপরীত অবস্থানে থেকে আমন্ত্রিত কর্মকর্তা বা ব্যক্তি প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
সংসদীয় কমিটিতে বিরোধীদের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। যেমন, সংসদীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হতে পারে কোনো দলের মোট প্রাপ্ত সংখ্যার অনুপাতে। আরেকটি উপায় হতে পারে, মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সরকার ও বিরোধী দল তলব করার সুবিধা পাবে। ধরা যাক, সরকারি জোট ৫০ শতাংশ ও প্রধান বিরোধী জোট ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারি জোট ৫টি তলব করলে, প্রধান বিরোধী দল বা জোট ৪টি তলবের সুবিধা পাবে।
তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো দল বা একই ককাসে থাকা জোট কোনো সংসদীয় কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে না।
একজন সদস্য কেবল একটি কমিটিরই সভাপতি বা বিরোধী দলীয় প্রধান র্যাংকিং সদস্য হতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদে প্রত্যেক সদস্য সমান সময় ভোগ করবেন।
কোনো দলের সংসদীয় হুইপ — যিনি কোনো নির্বাহী ও অন্য সংসদীয় পদে থাকবেন না — তিনি সংসদীয় কমিটিতে নিজ নিজ দলের সদস্য প্রস্তাব করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তিনি দলের রাজনৈতিক নেতা, সংসদীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতা কারো আপত্তি মেনে চলতে বাধ্য নন।
সংসদে প্রতি মাসে একবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দলীয় নেতার বাহাস (যাকে যুক্তরাজ্যে Prime Minister’s Questions বলা হয়) অনুষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে উভয়কেই আগে থেকে নির্ধারিত সমান সময় পাবেন।
প্রত্যেক সংসদ সদস্যের ঢাকায় ও নিজ নির্বাচনী আসনে সরকারি কার্যালয় থাকবে। সরকারি খরচে সাচিবিক দায়িত্বের জন্য একজন সাচিবিক কর্মকর্তা, একজন আইনি বা সংসদ বিষয়ক লেজিসলেটিভ কর্মকর্তা ও অন্তত পাঁচ জন কর্মকর্তা নিজের পছন্দ অনুযায়ী সরকারি বেতনে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দিতে পারবেন।
সংসদীয় প্রতিটি বিল ও আইনে গণ-মতামত গ্রহণের প্রক্রিয়া অনলাইন করতে হবে। কোনো আইন বিষয়ে সংসদের কোনো কমিটি বা সদস্য কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী বা আংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করলে, ওই বৈঠকের কার্যবিবরনী ও আক্ষরিক-বিবরণী প্রকাশ করতে হবে।
একজন সংসদ সদস্যকে নৈতিক স্খলনের অপরাধে স্ব স্ব কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিশংসন করা যাবে। এছাড়া একজন সংসদ সদস্য সর্বোচ্চ আদালতে ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হলে তার পদ হারাবেন।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও সমমানের পদে (যেমন, নির্বাচন কমিশনার) নিয়োগের ক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন হবে। রাষ্ট্রপতি ব্যতীত অন্যান্য পদে স্ব স্ব নিয়োগ কমিশনের প্রস্তাবকৃত নামের প্রার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে সংসদীয় কমিটিকে। অন্তত ৪১ শতাংশ ভোটে কাউকে একবার প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা সংসদকে ও/অথবা সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিকে দিতে হবে। পরবর্তী ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যানে ৫১ শতাংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। তারও পরবর্তী ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যানের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। এতে করে বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে দায়িত্বশীল উপায়ে ক্ষমতা চর্চা করার সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে। শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা গড়ে উঠাও অসম্ভব নয়।
বিচারপতিদের ক্ষেত্রে আরেকটি উপায় হতে পারে: প্রধান বিচারপতির ২৫ শতাংশ ভোটাধিকার এবং সংসদীয় গণভোট ৭৫ শতাংশ ভোট পাওয়া দলগুলোর সংসদীয় নেতাদের আনুপাতিক হারে ৭৫ শতাংশ ভোট থাকবে। মোট অন্তত ৬০% ভোটে এই পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে।
আরেকটি উপায় হতে পারে: অন্যান্য সাংবিধানিক পদের মতো বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী নাম প্রস্তাব করতে পারবেন, তবে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলীয় নেতার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে।
প্রধান বিচারপতি পদে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়োগ পাবেন।
রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ও সমমানের পদে (যেমন, নির্বাচন কমিশনার) অভিশংসন করার ক্ষমতা সংসদকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন হবে।
অন্যান্য সকল সাংবিধানিক পদ, সাংবিধানিক কমিশনের সদস্য, প্রতিরক্ষা বাহিনী, কেন্দ্রীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগসমূহের প্রধানদের পদে একাধিক ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিতে পারবেন। সরকারের প্রস্তাবিত একাধিক প্রার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির থাকবে। অন্তত ৪১ শতাংশ ভোটে কাউকে একবার প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা সংসদকে ও সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিকে দিতে হবে। পরবর্তী ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যানে ৫১ শতাংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। তারও পরবর্তী ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যানের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। এতে করে বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে দায়িত্বশীল উপায়ে ক্ষমতা চর্চা করার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশ প্রশাসন সংক্রান্ত পদে বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে বদলি ও বরখাস্তের ক্ষেত্রে নির্বাহী সরকার সুপারিশ করবে। তবে বর্তমান মন্ত্রীপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, প্রশাসনের জ্যেষ্ঠতম সচিব এবং জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সাবেক দুইজন মন্ত্রীপরিষদ সচিবের একটি প্রশাসনিক কাউন্সিল থাকবে — যাদের যেকোনো একজন সদস্যের আপত্তিতে এই ধরণের নিয়োগে ভোটাভুটি হওয়ার প্রয়োজন হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাহী সরকারের সুপারিশ এই কাউন্সিল প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকবে। স্ব স্ব শহরের মহানগরের মেয়র, জেলার ক্ষেত্রে পরিষদ চেয়ারম্যান এই কমিশনের সদস্য হবেন; বেজোড় সংখ্যার স্বার্থে সেক্ষেত্রে কনিষ্ঠতর সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব বাদ যাবেন। এই কমিশনের সকল কার্যপরিধি ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশিত হবে।
একইভাবে — বাংলাদেশ পুলিশ অথবা প্রধানতম কেন্দ্রীয় পুলিশিং সংস্থার জেলা ও থানা পর্যায়ে বদলি ও বরখাস্তের ক্ষেত্রে নির্বাহী সরকার সুপারিশ করবে। তবে বর্তমান ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) বা সংস্থার প্রধান ও চাকরিতে যোগদানের বয়স অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা (আইজিপি জ্যেষ্ঠতম হলে তার পরের জন) এবং জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সাবেক তিনজন আইজিপির একটি কমিশন থাকবে — যাদের যেকোনো একজন সদস্যের আপত্তিতে এই ধরণের নিয়োগে ভোটাভুটি হওয়ার প্রয়োজন হবে। মহানগর অঞ্চলে স্ব স্ব শহরের মেয়র ওই কমিশনের সদস্য হবেন; বেজোড় সংখ্যার স্বার্থে সেক্ষেত্রে কনিষ্ঠতর সাবেক আইজিপি বাদ যাবেন। এই কমিশনের সকল কার্যপরিধি ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশিত হবে।
সামরিক কোনো বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে যুক্ত করা যাবে না। র্যাব, ডিজিএফআই ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী সহ অন্যান্য যেকোনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থায় সামরিক বাহিনী থেকে পদায়ন বন্ধ করতে হবে।
দেশের গোয়েন্দা সংস্থা হবে দুই রকম: একটি বৈদেশিক আরেকটি অভ্যন্তরীণ। অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের পদ সবসময় বেসামরিক হতে হবে।
অভ্যন্তরীণ প্রধান গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থার প্রধান ভারতের মতো প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারেন। তাদের মধ্যে ঐক্যমত্য না হলে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেতা সংসদে প্রকাশ্যে প্রার্থীকে প্রশ্নোত্তর করা ও ভোটাভুটির অনুরোধ জানাতে পারেন।
বিচার বিভাগের সংস্কার
চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে হাইকোর্টের আলাদা বেঞ্চ থাকবে। চট্টগ্রামে হাইকোর্টে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিশেষ বেঞ্চ থাকতে পারে — যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের Court of Chancery, যেটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ মালিকানা সংক্রান্ত নিষ্পত্তি নির্ধারণের বিশেষজ্ঞ আদালত।
হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বেঞ্চ প্রধান বিচারপতি একাই নির্ধারণ করতে পারবেন না। হাইকোর্ট বেঞ্চের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ একজন বা দুইজন বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্মতির ভিত্তিতে বেঞ্চ গঠিত হবে। ঠিক একইভাবে নিম্ন আদালতেও সমমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের পদ্ধতি থাকতে হবে।
যেকোনো পর্যায়ের বিচারক নিয়োগ, বদলি বা বরখাস্ত করার বিচার বিভাগের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। এক্ষেত্রে বর্তমান প্রধান বিচারপতি, বর্তমান প্রধান বিচারপতির সুপারিশক্রমে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির একটি জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকেও স্ব স্ব কাউন্সিলে রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের ‘কনটেম্পট অব কোর্ট’ ধারা, বিধান, প্রবিধান, আইন — সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে হবে। শুধুমাত্র আদালতের স্পষ্ট লিখিত নির্দেশ এবং আদালতে উপস্থিত থাকা অবস্থায় মৌখিক নির্দেশ অমান্য করা হলে, ‘কনটেম্পট অব কোর্ট’ প্রক্রিয়া কোনো বিচারক কিংবা বিচারপতি শুরু করতে পারবেন।
বিচারপতিদের তলব করার ক্ষমতা সংসদীয় কমিটির থাকবে। তবে সংসদ অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। যেকোনো বিচারক, বিচারপতি, সংসদ সদস্য বা যেকোনো জনপ্রতিনিধির ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা অ্যাটর্নি জেনারেলের (অ্যাটর্নি জেনারেল পদে সংস্কার প্রস্তাবনা নিচে দ্রষ্টব্য) থাকবে।
বাংলাদেশের বারে যেকোনো আইনজীবীর বিরুদ্ধে অসদচারণের অভিযোগ দায়ের করা হলে তা নিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের প্যানেল করে বিচার করতে হবে। এই বিচারের প্রক্রিয়ার সকল কার্যবিবরণী, স্বাক্ষ্যগ্রহণ একটি বিচারালয়ের মতো অনুষ্ঠিত হবে এবং জনসম্মুখে প্রকাশিত হতে হবে। বাংলাদেশে ডিবারমেন্ট প্রক্রিয়া না থাকলে আইনজীবীদের অসততা ঠেকানো যাবে না। যেমন, আদালতে ভুয়া প্রমাণ দাখিল, মিথ্যা স্বাক্ষ্য জোগাড় করা, ইত্যাদির সংস্কৃতি এমনি এমনি গড়ে উঠেনি।
অডিটরদের বিষয়েও একই ধরণের ব্যবস্থা প্রয়োজন।
ফৌজদারি ও দেওয়ানি ব্যবস্থার সংস্কার
বাংলাদেশের বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের নিজস্ব উকিল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আদালতে সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ‘সলিসিটর জেনারেল’ পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এছাড়া সংসদীয় আইন সংক্রান্ত বিষয়ে মতামতের দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকতে পারে।
বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাকে হ্রাস করতে হবে। বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেল পদকে ক্ষমতায়িত করতে হবে।
যুক্তরাজ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলই রাষ্ট্রের প্রধান কৌঁসুলি; কিন্তু তিনি সরকারের একজন মন্ত্রীর মতো রাজনৈতিক বিষয়-আশয়ও সামলান; যুক্তরাজ্যে বিচার মন্ত্রণালয় আলাদা। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাটর্নি জেনারেলই আইন ও বিচার মন্ত্রী। তবে তিনি রাজনৈতিক আচরণ সচরাচর করেন না এবং তার আওতাধীন বিভাগসমূহের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি বা হোয়াইট হাউজের দূরত্ব কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পদটিকে স্বাধীন রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ইসরাইলি মডেল দেখা যেতে পারে — যেখানে অ্যাটর্নি জেনারেল অত্যন্ত ক্ষমতাধর ও অরাজনৈতিক।
অ্যাটর্নি জেনারেলের পদমর্যাদা মন্ত্রী সমকক্ষ হতে পারে তবে তিনি মন্ত্রীসভার সদস্য হবেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও জবাবদিহি করবেন না। তবে তাকে সংসদের আইন ও বিচার বিষয়ক কমিটি তলব করতে পারবে। তার নিয়োগ হতে হবে সরকার, বিরোধী দল ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতির মাধ্যমে। অথবা, অন্যান্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগের মতো সংসদকে প্রথমে ৪১% ভোটে প্রথম প্রার্থী, ৫১% ভোটে দ্বিতীয় প্রার্থী এবং দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তৃতীয় প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যানের সুযোগ দিয়ে। এই পদে একজন ব্যক্তি একবারই নিযুক্ত হতে পারবেন। তার পদের মেয়াদ হবে ১০ বছর। মেয়াদের আগে শুধুমাত্র সংসদে অভিশংসনের মাধ্যমে তাকে বরখাস্ত করা যাবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল হবেন বার-পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ একজন আইনজীবী, যার রয়েছে কমপক্ষে ৫ বছর নিম্ন আদালতে ও কমপক্ষে ১০ বছর উচ্চ আদালত মিলিয়ে মোট ২০ বছর প্রধান আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়ার অভিজ্ঞতা। এক্ষেত্রে বিচারক বা বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও বিবেচনায় রাখা যায়।
বাংলাদেশে একটি ‘প্রসিকিউটোরাল এজেন্সি’ থাকতে হবে। যেমন, যুক্তরাজ্যের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস। এই প্রসিকিউটোরাল এজেন্সির প্রধান হবেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
পুলিশের হাত থেকে প্রসিকিউশনের দায়িত্ব কেড়ে নিতে হবে। তারা আইন-শৃঙ্খলা ও তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। আদালতে মামলা লড়ার যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তাদের থাকে না। এই কারণে অনেক অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। আর পুলিশ পরে এসে ‘ক্রসফায়ার’ বা গুম জায়েজ করতে পারে। বর্তমানে স্বল্পমেয়াদে সামান্য ক্ষমতা দিয়ে দলীয় আইনজীবীদের পিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার স্থলে ‘প্রসিকিউটোরাল এজেন্সি’র অধীনে সারাদেশে কৌঁসুলি পদে পাবলিক সার্ভিস পদের মতো ন্যূনতম চার বছরের আইন ডিগ্রি রয়েছে ও বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এমন ব্যক্তিকে আলাদাভাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কেউ প্রসিকিউটর পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে যেতে পারে এবং এই ধরণের ব্যক্তিকে অ্যাটর্নি জেনারেলের সম্মতিতে পুনরায় নিয়োগপরীক্ষা ব্যতীতই নিয়োগ দেওয়া যাবে।
একটি ফৌজদারি মামলায় স্থানীয় আদালতে অভিযোগ গঠন ও পেশ করা হবে কি হবে না, তা জেলার প্রধান প্রসিকিউটর ঠিক করবেন। পুলিশের অনুসন্ধান শেষে মামলা লড়বেন প্রসিকিউটর কার্যালয়ের কৌঁসুলিরা। এতে করে আদালতে মামলার জট কমবে, পুলিশের একচ্ছত্র হয়রানি বন্ধ হবে।
একটি জেলার প্রধান প্রসিকিউটর পদে কারো নিয়োগ ৬ বছর হবে। তাকে মেয়াদ শেষের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল এককভাবে বদলি করতে পারবেন না — এক্ষেত্রে মুখ্য হাকিমের সম্মতি প্রয়োজন হবে। দুইটি বা ততোধিক জেলা সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য বিশেষ প্রসিকিউটর থাকবে। শুধুমাত্র বিরল ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেল বিশেষ কিছু তদন্তে বেসরকারি এমনকি বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন।
এছাড়া আলাদা একটি কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানী সংস্থা (যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই, ভারতের সিবিআই, যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড অফিস) থাকবে। এই সংস্থার প্রধান অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশনা অনুযায়ী অনুসন্ধান করবেন, তবে তার নিয়োগ হবে সরকার, প্রধান বিরোধী দল ও প্রধান বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্মতির ভিত্তিতে। এই পদের প্রধান হবেন একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ, সামরিক পুলিশ, অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা, যিনি এই দায়িত্ব শেষে নিজ বাহিনীতে ফেরত যেতে পারবেন না।
তার পদের মেয়াদ হবে অন্তত ৬ বছর, যেন তিনি রাজনৈতিক আনুগত্য বা চাপের উর্ধ্বে থাকতে পারেন। মেয়াদ শেষের আগেই তাকে বরখাস্ত করতে হলে প্রধানমন্ত্রী অথবা অ্যাটর্নি জেনারেল সুপারিশ করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ হলে অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান বিচারপতি ও প্রধান বিরোধী দলীয় নেতার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বরখাস্ত করা যাবে। অ্যাটর্নি জেনারেলের সুপারিশ এলে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও প্রধান বিরোধী দলীয় নেতার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে।
বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও বেসামরিক র্যাবের সম্মিলন ঘটিয়ে এই সংস্থা সৃষ্টি করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে এই ব্যুরো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ বাহিনীর অধীনে থাকবে না। এই ব্যুরো কাউকে ডেপুটেশনে নিয়োগ দেবে না: কোনো কর্মকর্তা একবার এই বিভাগে এলে নিজ বাহিনীতে বা সংস্থায় ফেরত যেতে পারবেন না। এই ব্যুরোর নিজস্ব জনবলও থাকবে। ক্ষেত্রেবিশেষে স্থানীয় পুলিশের সহায়তাও চাইতে পারবে এই সংস্থা। বিচারাধীন বিষয়ের ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ থেকে বুঝে নিতে পারে এই সংস্থা। কোনো মামলার পরিধি দুই বা ততোধিক থানার জুরিসডিকশনে ছড়িয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলার দায়িত্বভার এই সংস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
এই ব্যুরোর অনুসন্ধান অনুযায়ী মামলা প্রসিকিউট করবেন প্রসিকিউটোরাল এজেন্সির একজন বিশেষ প্রতিনিধি।
যেহেতু এটি অনুসন্ধানী সংস্থা, এটি কোনো বাহিনী নয়। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশের সহায়তা গ্রহণ ছাড়াও নিজস্ব সোয়াট টিম ব্যবহার করতে পারবে এই সংস্থা।
পুলিশের বর্তমান সাইবার অপরাধ অনুসন্ধানের ইউনিট ও সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ইউনিটও আলাদা আলাদা ব্যুরো হিসেবে এই সংস্থার অধীনে থাকবে।
বাংলাদেশের এই প্রসিকিউটোরাল এজেন্সি ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ব্যতীত রাষ্ট্রের যেকোনো জনপ্রতিনিধি, বিচারপতি ও নির্বাহী বিভাগের যেকোনো নির্বাচিত ও অনিবার্চিত কর্মকর্তার দুর্নীতি, অসদচারণ, ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অন্য যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের সন্দেহে অনুসন্ধান করতে পারবেন।
সরকারে অধিষ্ঠিত কোনো কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধির দুর্নীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত তদন্ত জন্য এই প্রসিকিউটোরাল এজেন্সির আলাদা ব্যুরো থাকবে। এই ব্যুরো দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রতিস্থাপিত করবে।
এর বাইরে প্রতারণা, অর্থ পাচার, সহিংস সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, ইত্যাদি গুরুতর অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে অ্যাটর্নি জেনারেলের অধীনে প্রতিস্থাপিত করতে হবে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং এজেন্সিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে স্বাধীন ব্যুরো হিসেবে সমন্বিত করতে হবে। ইন্টারনেট বন্ধ করার কোনো অধিকার এই ব্যুরোর থাকবে না। শুধুমাত্র ফৌজদারি অপরাধ সংক্রান্ত কাজে জেলা ও বিশেষ প্রসিকিউটর স্বাক্ষরিত আবেদনের ভিত্তিতে একজন বিচারকের লিখিত অনুমোদনের পরই কোনো ব্যক্তির টেলিযোগাযোগে ওয়্যারট্যাপ বা নজরদারি পরিচালনা করা যাবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াতে কোনো বিচারকের কাছ থেকে দ্রুত অনুমতি নিতে বিচারক ও প্রসিকিউটরদের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। শুধুমাত্র বিচারকের অনুমতি প্রাপ্ত পত্র এনটিএমসির কাছে এসে পৌঁছালেই, সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত নম্বরসমূহে ওয়্যারট্যাপ করতে অনুমতি পাবে সংস্থাটি। অন্য যেকোনো ধরণের ওয়্যারট্যাপ অবৈধ বলে আইনে অস্পষ্ট উল্লেখ থাকবে।
তবে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে তধুর্ধ্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যেকোনো পর্যায়ের বিচারক ও বিচারপতির উপর ‘ওয়্যারট্যাপ’, গোপন নজরদারি ও তল্লাশি চালাতে হলে জ্যেষ্ঠতম পাঁচ সদস্যের জুডিশিয়াল কাউন্সিল বা অনুরূপ পরিষদের অনুমতি নিতে হবে। জেলা ও পৌর পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে জেলার মুখ্য হাকিম এবং সংসদীয় ও মহানগর পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হতে পারে। তবে কোনো বিচারক বা বিচারপতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান থাকলে, তারা এই কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। সেক্ষেত্রে তাদের আগে অবসর নিয়েছেন, এমন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠতর বিচারক বা বিচারপতিদের নিয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হতে পারে। (ইন্দোনেশিয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা এখানে বিবেচ্য হতে পারে।) এই কাউন্সিল নির্দিষ্ট কোনো সংস্থা নয়। বরং, এই কাউন্সিল গঠনের জন্য প্রতিটি ঘটনায় অ্যাটর্নি জেনারেল জ্যেষ্ঠতার ধারা অনুযায়ী লিখিতভাবে অনুরোধ করে এই কাউন্সিল গঠনের আবেদন জানাবেন। এই কাউন্সিলের অস্তিত্ব ও কার্যপরিধি কেবলমাত্র অনুসন্ধান শেষ হওয়া পর্যন্ত গোপন থাকবে।
প্রসিকিউটোরাল এজেন্সির পাশাপাশি প্রতিটি জেলার ‘পাবলিক ডিফেন্ডার’ও সরকারিভাবে নিয়োজিত হবেন। কোনো ব্যক্তি নিজস্ব খরচে আইনজীবী নিয়োগ দিতে না পারলে পাবলিক ডিফেন্ডার আইনজীবী সরবরাহ করবে। স্বেচ্ছাসেবা, ব্যক্তিগত দান ও সরকারি খরচে এই কার্যালয় চলবে।
স্ব স্ব জেলা পরিষদ ও ওই জেলার সকল উপজেলা পরিষদ সদস্য পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে পাবলিক ডিফেন্ডার পদে জেলা পর্যায়ে দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেবেন — তিনি এই পদে থাকা অবস্থায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যক্তিগত চেম্বার বা প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখতে পারবেন না। এই কার্যালয়ের যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে সরকারের কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির সরাসরি বা পরোক্ষ যোগাযোগ অবৈধ। শুধুমাত্র মামলা সংক্রান্ত কাজে সরকারি কৌঁসুলিরা যোগাযোগ করতে পারবেন।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের জট কাটাতে হলে অনানুষ্ঠানিক গ্রাম্য সালিশ ব্যবস্থাকে কিছু স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ও ইউনিয়নে দেওয়ানি বিরোধে সালিশি ব্যবস্থা থাকতে পারে — তবে সংক্ষুদ্ধ কেউ ওই সিদ্ধান্ত আদালতে আপিল করতে পারবেন। এই শালিসি বোর্ডের সাচিবিক কাজের জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এই শালিসি বোর্ডের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিবেচনার জন্য উপলভ্য থাকতে হবে।
দেওয়ানি সংক্রান্ত মামলার বিচার পরিচালনার জন্য উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি আদালত থাকতে পারে।
বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে দুর্নীতি, ইনসাইডার ট্রেডিং বা অন্যান্য অপরাধ তদন্তে পৃথক ও স্বতন্ত্র আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থাকতে পারে। এই সংস্থা নিয়ন্ত্রক সংস্থা নয়; বরং এই সংস্থার প্রসিকিউশনের ক্ষমতা থাকবে। আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবীরা এই প্রসিকিউশনের দায়িত্বে থাকবেন। শুধুমাত্র স্টক মার্কেট সংক্রান্ত অপরাধে ফৌজদারি সাজা বা দেওয়ানি জরিমানা বা স্টক মার্কেট থেকে নিষেধাজ্ঞা — ইত্যাদি সাজা চেয়ে আদালতে অভিযোগ গঠন করতে পারবেন এই কৌঁসুলিরা। এসব পদে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি যৌথ কমিটি নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করবে। এই সংস্থার প্রধান সংসদীয় শুনানি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদনের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এই সংস্থা কেন্দ্রীয় প্রসিকিউটোরাল এজেন্সির আওতাভুক্ত হবে না।
সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ
প্রত্যেক জাতীয় সরকারের মেয়াদের আড়াই বছর পূর্তিতে সকল পর্যায়ের স্থানীয় সরকার (শহরের মেয়র-কাউন্সিল, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন) নির্বাচন একসঙ্গে ঘটবে। এতে করে একটি সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণ আগেই রায় দিতে পারবে — যার ফলে পাঁচ বছর ক্ষমতা আছে ভেবে তুষ্ট থাকবে না কোনো সরকার।
বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে আদালতে ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত করা, গুরুতর নৈতিক স্খলনের জন্য সংসদের নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে বহিষ্কৃত করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের স্বাক্ষরে একজন মেয়র বহিষ্কৃত হতে পারেন না। তবে উপজেলা পরিষদ পর্যায় থেকে নিম্নতর ইউনিটের জনপ্রতিনিধির অসদাচরণের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুরোধের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব সরকারের পক্ষ থেকে সম্মতি জানালে, ওই পদে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় পুনরায় ভোট আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে পারে নির্বাচন কমিশন।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন নির্বাহী ক্ষমতা দিতে হবে। শহরে মেয়রের হাতে কিছুটা ক্ষমতা দিতেই হবে। বিভাগীয়, জেলা ও পৌর শহরের পুলিশের বিভিন্ন পদ (যেমন, ট্রাফিক পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস) মেয়রের হাতে দিতে হবে।
জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরাসরি ভোটে পরিষদ নির্বাচন হবে। চেয়ারম্যান ও পরিষদের হাতে আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ক্ষমতা দিতে হবে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্ব স্ব পরিষদের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন। বিভাগীয় কমিশনার মহানগরের মেয়রের কাছে জবাবদিহি করবেন।
এসব কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়টি জাতীয় বা জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিলের আওতাধীন থাকবে; তাদের ক্যারিয়ার ফাইলে মন্তব্য করার অধিকার থাকবে স্ব স্ব চেয়ারম্যানের।
জেলা ও উপজেলার চেয়ারম্যান অথবা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য থানার ইউএনও/ওসি বা জেলার ডিসি/এসপির বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগে প্রশাসনিক কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন — যেই বিষয়ে এক মাসের মধ্যে কমিশন শুনানি আয়োজন করতে বাধ্য।
বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, পৌরসভা বা ইউনিয়নে একটি কার্যালয় থাকবে। এই কার্যালয় থেকে প্রতিটি প্রত্যেক ওয়ার্ডে বিদ্যমান বাসা-বাড়ির নিবন্ধন হবে এবং ভবিষ্যতের বাসাবাড়ি নির্মানের অনুমতি নিতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় শুধুমাত্র ভূমি অবস্থান ও মালিকানা দেখিয়ে অনলাইনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই অনুমোদন নেওয়া যাবে। বাংলাদেশে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা অথবা ওয়ার্ড, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন — এই দুই ধরণের প্রশাসনিক ইউনিট। এই প্রশাসনিক ইউনিটের সঙ্গে ‘জিপ কোড’ যুক্ত থাকবে। এর সঙ্গে বাসা নম্বর ও ক্ষেত্রবিশেষে অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর যুক্ত হয়ে নির্ধারিত হবে প্রতিটি বাড়িঘর বা বাসাবাড়ির ঠিকানা।
অন্তত ওয়ার্ড পর্যায়ে ওয়ার্ড কমিশনার বা সদস্যের পাশাপাশি ভূমি অফিস (যা বর্তমানে তহসিলদার অফিস হিসেবে পরিচিত), বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, কম্যুনিটি ক্লিনিক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমন্বিত কার্যালয় থাকতে হবে। এই চার সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই ওয়ার্ড পর্যায় থেকে সুষ্ঠু উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে — যা দেশের সরকারি, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সূচক প্রকাশে কাজে লাগবে। প্রতিটি ওয়ার্ডের জনসংখ্যা অনুপাতে এসব কার্যালয়ের কর্মী সংখ্যা নির্ধারিত হবেন। সুবিধার স্বার্থে অস্থায়ী কর্মীও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
তবে ইউনিয়নের এসব ক্ষমতায় উপজেলা ও জেলা পরিষদ উত্তরোত্তর (ওভাররাইডিং) ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সামগ্রিক একটি কমিশন থাকবে। এই কমিশন সাংবিধানিক বলে বিবেচিত হবে, যার প্রধান ও সদস্যগণ সংসদ কর্তৃক অন্যান্য সাংবিধানিক পদের মতো নিয়োজিত হবেন। কোনো বিষয়ে জাতীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো বিরোধ বা আইনগত সংঘর্ষ তৈরি হলে এই কমিশনের কাছে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিগণ আবেদন জানাতে পারবেন। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই কমিশন পরিস্থিতি বিবেচনায় উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। তেমনি জাতীয় সরকার নিজের সলিসিটর জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে কোনো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে, এই কমিশনের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়কে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে।
সরকারের পক্ষে এই সংক্রান্ত কাজে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর জেনারেলের কার্যালয় প্রতিনিধিত্ব করবে।
সাধারণ স্বচ্ছতা, উন্মুক্ততা ও জবাবদিহিতা
কোনো ব্যক্তি কেন্দ্রীয় নির্বাহী সরকারের মহাপরিচালক বা তধুর্ধ্ব পর্যায়ের সামরিক বা বেসামরিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর বা বোর্ড অব গভর্নর্সের সদস্য বা তদুর্ধ্ব, বিচার বিভাগের যেকোনো পর্যায়ের বিচারক, সংসদীয় যেকোনো কমিটির সদস্য, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র, সরকারের মন্ত্রীসভার যেকোনো পর্যায়ের সদস্য, বাংলাদেশের সাংবিধানিক যেকোনো কমিশনের সদস্য, বাজার প্রতিযোগিতা ও স্টক মার্কেট বিষয়ক সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বা সাংবিধানিক যেকোনো অস্থায়ী বা স্থায়ী এনটিটির সদস্য হলে, তিনি সরাসরি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না। তিনি ”ব্লক অ্যাকাউন্ট“ খুলে অর্থ রাখতে পারবেন, কিন্তু ওই অর্থ পরিচালনার কোনো নিয়ন্ত্রণ তার থাকবে না। ওই ব্লক অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য পেশাদার কোম্পানি থাকতে পারে, যাদেরকে তিনি শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট কোনো পরামর্শ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে পারবেন না।
এই ধরণের পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যরা (ভাই-বোন, পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান) বা তাদের কোনো ধরণের মালিকানা রয়েছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান সরকারের স্ব স্ব সংস্থার সঙ্গে কোনো ধরণের ব্যবসায় জড়িত হতে পারবে না।
বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারি বা তাদের পরিবারের সদস্যরা (ভাই-বোন, পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান) বা তাদের কোনো ধরণের মালিকানা রয়েছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান তার নিজ কর্মস্থলের সঙ্গে কোনো ধরণের ব্যবসায় জড়িত হতে পারবে না।
এ ক্ষেত্রে সাধারণ যেকোনো নাগরিকের প্রসিকিউটরাল এজেন্সির কাছে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা থাকবে।
বাংলাদেশের প্রত্যেক লিমিটেড কোম্পানির মালিকানা (আল্টিমেট বেনেফিশিয়ারি) পাবলিক রেকর্ড হতে হবে, যা এপিআই ও অন্যান্য প্রবেশযোগ্য উপায়ে নির্দিষ্ট ফরম্যাটে প্রকাশিত থাকবে। যেকোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকাধীন নতুবা লিমিটেড বা পাবলিক কোম্পানির আওতাধীন হতে হবে। ‘ট্রেড লাইসেন্স’ নামে আজগুবি ব্যবস্থা বাদ দিতে হবে। যেকোনো জেলা ও পৌর শহরে লিমিটেড কোম্পানি খোলার জন্য জেলা পরিষদ কিংবা পৌর কার্যালয়ের আওতাধীন একটি আলাদা অফিস থাকবে। এছাড়া অনলাইনেও যথাযথ তথ্য যাচাই সাপেক্ষে কোম্পানি খোলা যাবে।
বাংলাদেশের অস্পষ্ট ও সরকারের পক্ষে মেনে চলা অত্যন্ত দুরূহ ‘তথ্য অধিকার আইন’ পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের Sunshine Act-এর অনুরূপ ‘পাবলিক রেকর্ডস আইন’ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি সরকারের কাছে বিদ্যমান রেকর্ডস চাইতে পারবেন (যেমন, হিসাব নিকাশ, দলিল দস্তাবেজ, ইমেইল, চিঠিপত্র, অভ্যন্তরীণ অন্যান্য নথিপত্র, ইত্যাদি।) ব্যক্তিগত তথ্য ও জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট তথ্য মুছে যেকোনো রেকর্ড জনগণকে সরবরাহ করতে সরকার বাধ্য থাকবে। সরকারের যেকোনো নির্বাহী সংস্থা বা বিভাগ, সাংবিধানিক ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, সরকারের সহায়তা প্রাপ্ত বেসরকারি কোম্পানির প্রকল্প এই আইনের আওতায় থাকবে। এই ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পে প্রতি ৬০ জন কর্মকর্তা বা কর্মচারির বিপরীতে একজন পূর্ণকালীন এবং ৩০ জন কর্মকর্তা/কর্মচারির বিপরীতে অর্ধকালীন তথ্যপ্রদানকারী কর্মকর্তা থাকবেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে একটি স্বাধীন সাংবিধানিক কমিশনের আওতাধীন ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশের জনমিতি, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক জরিপ প্রতি বছর নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে ইন্টারনেটে ইন্টারঅ্যাকটিভ উপায়ে। প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ের উপাত্ত নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের data.census.gov দ্রষ্টব্য।
আয়কর-মুক্ত প্রত্যেক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে জনসম্মুখে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব, শীর্ষ পাঁচ শতাংশ নির্বাহীর বেতন-ভাতা, কেনাকাটা ও কন্ট্রাক্টর তালিকা, ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত বিষয় প্রতি বছর প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের Form 990 দ্রষ্টব্য।
বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের আদালতের প্রত্যেকটি নথিপত্র, মামলার কার্যপরিধি অর্থাৎ আদালত কর্তৃক সিলড না হওয়া সকল রেকর্ড পাবলিকলি একসিসিবল থাকতে হবে অন্তত ৫০ বছর পর্যন্ত। ব্রাজিলের https://www.jusbrasil.com.br/ ডাটাবেইজ দ্রষ্টব্য।
১০০ জনের বেশি কর্মচারী ও কর্মকর্তা আছে - এমন যেকোনো সরকারি সংস্থা বা বিভাগে একজন অভ্যন্তরীণ পরিদর্শক থাকবেন, যিনি হবেন একজন আইনজীবী। এই কর্মকর্তা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে যেকোনো কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। এই পরিদর্শক তদন্ত, অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ সাপেক্ষে কাউকে বরখাস্ত, বদলি বা অন্যান্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করতে পারবেন। এমনকি তিনি কেন্দ্রীয় প্রসিকিউটোরাল এজেন্সির কাছে ‘ক্রিমিনাল রেফারেল’ পাঠাতে পারবেন।
সরকারের যেকোনো খসড়া ও চুড়ান্ত ডিজিটাল ও কাগুজে নথিপত্র বা রেকর্ডস অন্তত ১০ বছর আর্কাইভ করে রাখতে হবে। যেকোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি সভার ট্রান্সক্রিপ্ট রেকর্ডস (অডিও ও লিখিত) রাখতে হবে। বর্তমানে শুধুমাত্র ‘মিনিটস’ রাখা হয় - যেখানে শুধু বেছে বেছে কিছু মন্তব্য যোগ করা হয়। সরকারের একটি আর্কাইভড এজেন্সি এক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকবে।
বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা কর্মচারি আনুষ্ঠানিক কাজ সম্পাদনের জন্য শুধুমাত্র সরকারি ইমেইল ও মোবাইল-টেলিফোন নম্বর ব্যবহার করতে পারেন। সরকারি কাজ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা ব্যক্তিগত নম্বর ও ব্যক্তিগত ইমেইল ব্যবহার করে করা অবৈধ ঘোষণা করা হবে। শুধুমাত্র গোয়েন্দা, পুলিশিং, ইত্যাদি সংস্থায় অনুসন্ধানজনিত কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সীমিত সময়ের জন্য এর আওতার বাইরে থাকবেন।
আর্থিক খাতে সংসদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি
সংসদের নিজস্ব স্বাধীন ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বাজেট বিশ্লেষণ কার্যালয় থাকবে, যেটি অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও বিরোধী দলীয় র্যাংকিং মেম্বারের কাছে জবাবদিহি করবে। এই কার্যালয় সরকারের চাওয়া বাজেটের প্রকৃত সম্ভাব্য আয়-ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখবে।
বিচার বিভাগ, সংসদের সাচিবিক বিভাগ, বিভিন্ন সাংবিধানিক কমিশন, কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদির বাজেট স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে সংসদীয় কমিটির কাছে পেশ হবে। এসব বাজেট সরকারি বাজেটের অন্তর্ভুক্ত হবে না। অন্তত এসব বাজেটের ক্ষেত্রে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।
নির্বাহী সরকারের নিজস্ব বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে ঋণ নিতে চাইবে, তা শুধুমাত্র ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে নিতে হবে। প্রতিটি ট্রেজারি বন্ড, বন্ডের মেয়াদ বা বন্ডের মাধ্যমে সম্ভাব্য কত টাকা উত্তোলন করা যাবে, সেই বিষয়ে সংসদের ৬০ শতাংশের সম্মতি লাগবে। সরকার চাইলে রাজস্ব আয় বাড়িয়ে অপারেশনাল ও উন্নয়নমূলক ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল (যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের বোর্ড অব গভর্নরস, যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটারি পলিসি কমিটি) দেশে ন্যূনতম সুদের হার ঠিক করবেন। এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল বা বোর্ডে সদস্য মনোনয়ন দেবেন প্রধানমন্ত্রী; তবে তাদের নিয়োগ সংসদে জন-শুনানি ও অন্তত ৬০% শতাংশ সমর্থনে অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এই প্যানেলের যেকোনো সদস্যের সঙ্গে সরকারের যেকোনো যোগাযোগ সরকারের আইন কর্মকর্তার মাধ্যমে হতে হবে। প্রতিটি যোগাযোগের বিবরণ এক বছর পর জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। সুদের হার নির্ধারণে আয়োজিত বৈঠকের কার্যবিবরণী ও লিখিত ট্রান্সক্রিপ্ট ৬ মাস পর প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো অবস্থাতেই ট্রেজারি বন্ড বা সরকারের ঋণ বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকবে না। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় সংসদ কর্তৃক যথাযথভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত বন্ড বিক্রি করতে পারবে।
বাংলাদেশের মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করবে। এই মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য থাকবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। এই দুই ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয় বা অন্যান্য মাধ্যমে বাজারে অর্থের সংকুলান বাড়ানো বা কমানোর যেকোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নিতে পারবে।
অর্থনৈতিক ও ব্যবসা খাতের অন্যান্য প্রস্তাবনা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মুদ্রাস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের সূচক প্রকাশ করতে হবে প্রতি মাসে। এই দুই সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল দেশের মুদ্রানীতি নির্ধারিত করবেন।
এই প্রস্তাব অত্যন্ত বিতর্কিত হতে পারে, তবে বাংলাদেশকে ক্রমেই কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ব্যাংক ও ডিজিটাল মুদ্রায় ঢুকে যেতে হবে। এর ফলে সরকার অনেক ক্ষমতা পাবে; মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা হয়তো লঙ্ঘিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতি ঠেকানো ও কর সংস্কারের জন্য আর কোনো ভালো উপায় জানা নেই।
একটা দেশে সরকারি বরাদ্দ ও রাজস্ব আদায় কতটুকু হবে, তা নির্ণয়ের জন্য হলেও এটা দরকার। প্রত্যক্ষ রাজস্ব আদায় না বাড়লে দেশে বৈষম্য থাকবেই। ডিজিটাল লেনদেনে করমুক্তি দিয়ে হলেও দেশের অন্তত ৮০-৯০ ভাগ লেনদেন ডিজিটাল করতে হবে। বাংলাদেশের মুদ্রাকে অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে ‘কনভার্টিবল’ করতে হবে। শ্রীলংকা, পাকিস্তান পর্যন্ত নিজেদের মুদ্রা পুরোদমে ডলারে ‘কনভার্টিবল’ করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক কোম্পানি কর্তৃক আরেক কোম্পানি ক্রয়, প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাওয়া, যোগসাজশের মাধ্যমে গ্রাহককে ঠকানো, বাজারে একটি কোম্পানির আধিপত্য, যোগসাজশের মাধ্যমে গুটিকয়েক কোম্পানির আধিপত্য — ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের মনোপলি ঠেকাতে এই কমিশনকে ব্যাপক ক্ষমতা দিতে হবে।
সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতা
ফৌজদারি মানহানি সংক্রান্ত যেকোনো আইন বাতিল করতে হবে।
আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরণের আড়িপাতা (ডিজিটাল, টেলি যোগাযোগ) অবৈধ হিসেবে গণ্য হতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম প্রযোজ্য নয়। ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে — যা এমনকি জরুরী অবস্থায়ও বন্ধ করা যাবে না।
কোনো ধরণের সংবাদমাধ্যম প্রকাশের অনুমোদনের ক্ষমতা সরকারের থাকবে না। যেকেউ সংবাদ মাধ্যম চালু বা প্রকাশ করতে পারবেন — কোনো অনুমতি ব্যাতিরেকেই। তবে সংবাদমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে হলে সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদকের নাম প্রকাশ্যে উপলভ্য হতে হবে।
তথ্য মন্ত্রণালয় সংবাদপত্র প্রচার সংখ্যা বা টিভির রেটিং নির্ধারণ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে পেশাগত আসোসিয়েশন পেশাদার জরিপ দিয়ে প্রচার সংখ্যা বা রেটিং নির্ধারণ করবে।
সরকারি বা সরকারি অর্থে পরিচালিত যেকোনো প্রতিষ্ঠানের দেয়া বিজ্ঞাপনে কোনো পত্রিকা বা টিভিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া বা না দেয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আদেশ অবৈধ বলে বিবেচিত হতে হবে। অনলাইন মাধ্যমেও সরকারি বিজ্ঞাপন চলবে।
যেকোনো প্রকাশনা কার্যালয়ের সঙ্গে সংবাদ বিষয়ক নয় সরকারের এমন যেকোনো ধরণের যোগাযোগ শুধুমাত্র আইন কর্মকর্তার মাধ্যমে হতে হবে।
দেশে সিভিল মানহানি আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সংবাদমাধ্যমকে কোনোভাবেই সূত্র প্রকাশে বাধ্য করা যাবে না; তেমনি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে তাকে উত্তরের সুযোগ দিতে হবে; না হলে মানহানি মামলায় ওই ব্যক্তির পক্ষে আদালতের ‘প্রিজুডিস’ থাকবে।
পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় সংস্কার
পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষার নিয়ম পাল্টাতে হবে। মুখস্থ করার প্রয়োজন এমন পরীক্ষা থাকার দরকার নাই। লিখিত পরীক্ষায় ব্যাকরণ-সংশ্লিষ্ট নম্বর ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ দ্বারা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হতে হবে। তবে লেখার মান দেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষকের নম্বর লাগবে।
কিছু খাতের নিয়োগে বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রিধারীদের আলাদা সুবিধা দেয়া যেতে পারে; যেমন: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে যারা পড়েছেন, তাদেরকে পররাষ্ট্র সংক্রান্ত নিয়োগে। সেসব খাতের নিয়োগে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষক থাকতে হবে। পাবলিক সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে অপরাধের ইতিহাস ও ঠিকানা যাচাই বাছাই ছাড়া আর কোনো ধরণের গোয়েন্দা বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক যাচাইবাছাই অবৈধ ঘোষণা করতে হবে।
যেকেউ যেকারো নিয়োগে সুপারিশ করতে পারেন। তবে যেকোনো ধরণের ‘রাজনৈতিক ও আদর্শিক’ মূল্যায়ন বা সুপারিশ অবৈধ করতে হবে।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ যে কেউ স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বেসরকারি খাতে যোগ দিতে পারবেন এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের মধ্যে সরকারি চাকরিতে তারা পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেই ফিরতে পারবেন। এই ধরণের অভিজ্ঞ ব্যক্তিবিশেষের জন্য আলাদা নিয়োগের একটি কোটা রাখা যেতে পারে। তবে পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ ব্যাচের অন্যান্য কর্মকর্তাদের উর্ধ্বে তারা নিয়োগ পাবেন না। কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে তারা অবসরকালীন সুবিধা বা পেনশন ৫৯ বছরের পরই পাবেন।
বাংলাদেশে প্রশাসনিক পদের অনেকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে থাকা অবস্থায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন খাতে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন — কিন্তু অনেক সময় তারা বদলি হয়ে যান অন্য মন্ত্রণালয়ে। এই অপচয় ঠেকাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও বিশেষ অভিজ্ঞ ব্যক্তিবিশেষকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সম্পর্কিত খাতে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে যত্রতত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার ইচ্ছাও কমে যাবে। পাশাপাশি, কর্মকর্তাদের ইন্সটিটিউশনাল দক্ষতাও গড়ে উঠবে।
কনট্রাক্টরের অর্থে বৈদেশিক সফরের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের প্লেজার ট্রিপ নিষিদ্ধ করতে হবে। এই ধরণের সফর পৃথিবীর যেকোনো দেশেই দুর্নীতির সামিল ভাবা হয়।
প্রশিক্ষণের জন্য শুধুমাত্র বৈদেশিক দাতা সংস্থা, জাতিসংঘ বা অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা ও সরকারের অর্থায়নে এবং কোনো সরকারি কেনাকাটা বা ব্যবসায়িক চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের (যেমন: বিভিন্ন থিঙ্কট্যাংক) আমন্ত্রণে বিদেশ যাওয়া যাবে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রশাসন ক্যাডারের সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। একজন সহকারী সচিবের মতো অনভিজ্ঞ কর্মকর্তা ভূমির মতো জটিল বিষয় সামলাতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রত্যেক খণ্ড ভূমির মালিকানা খুব সহজেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিজিটাইজ করা সম্ভব। ভূমি মালিকানা অবশ্যই পাবলিক রেকর্ড হতে হবে - যা সহজেই ইন্টারনেটে নিশ্চিত হওয়া যায়। এক্ষেত্রে ব্রাজিলের ভূমি ব্যবস্থাপনা দ্রষ্টব্য।
ভূমি বিভাগে তহসিলদার পদ বিলুপ্ত করে টেকনিশিয়ান পদে লোক নিয়োগ করতে হবে, যারা ArcGIS সহ স্যাটেলাইট সংক্রান্ত ভূমি ব্যবস্থাপনায় লাইসেন্সধারী।
বাংলাদেশের প্রত্যেক উপজেলায় স্থাপতব্য দেওয়ানি আদালতে পৃথকভাবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ বিভাগ থাকতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্বশাসন প্রয়োজন। তবে তার মানে এই নয় যে ভাইস চ্যান্সেলরের একনায়কতন্ত্র চলবে।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে হতে হবে। সিনেট নির্বাচন না হলে সরকারি অর্থায়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থগিত হয়ে যাবে। এই সকল নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
বর্তমানে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোপন সংশ্লিষ্টতা থাকে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই সিনেটের সুপারিশ অনুযায়ীই রাষ্ট্রপতি ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শতভাগ নিয়োগের পদ্ধতি থাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অন্তত ১০ শতাংশ ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। এদের মধ্যে অর্ধেক বিদেশী নাগরিকও হতে পারে — যদিও তাদের নিয়োগ হতে পারে চুক্তিভিত্তিক। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা প্রকাশনার তালিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইন্টারনেটে প্রকাশ করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমস্ত রেকর্ড (আদালতে বিচারাধীন বিষয়াবলী ও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যতীত) এক সপ্তাহের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রাজনৈতিক ও দলীয় সংগঠনের অধীনে ছাত্র বা শিক্ষক রাজনীতি চলবে না। এমনকি কোনো প্যানেল নির্বাচনও হওয়ার দরকার নাই। সবাই স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো মালিক থাকবেন না। প্রতি পাঁচ বছর পর পর গভর্নিং বডির নির্বাচন হতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভোটে। চেয়ারম্যান সহ কোনো বোর্ড সদস্য দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ধরণের কেনাকাটা বোর্ডের কোনো সদস্যের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বা আত্মীয়স্বজনের প্রতিষ্ঠান থেকে করা যাবে না।
প্রতিটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণে দৈনিক বা সাপ্তাহিক সংবাদ প্রকাশনা থাকা বাধ্যতামূলক। এখানে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রম ও মজুরীর বিনিময়ে কাজ করবেন। প্রকাশনার ব্যয় ভর্তিকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের চাঁদায় চলবে। একটি প্রকাশনায় বার্ষিক ৬-১২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকলেই হয়। এসব প্রকাশনায় প্রশাসন ও কোনো শিক্ষকের যেকোনো ধরণের হস্তক্ষেপ অবৈধ ও অসদাচরণের সামিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর সম্মান ও সম্মানোত্তর আধেয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে হবে।
নতুন কোনো প্রস্তাবনা থাকলে যোগ করুন